ভারতীয় কূটনীতিকেরা কানাডার মাটিতে হত্যাকাণ্ড, চাঁদাবাজি, অপহরণ, জবরদস্তি ও হয়রানির মতো ‘অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে’ জড়িত—এমন অভিযোগ করার পর ভারত ও কানাডার সম্পর্ক ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডা দেশটিতে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারসহ ভারতের ছয়জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। তাঁরা নানা ধরনের হুমকিমূলক আচরণে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ করেছে কানাডা। ভারতও পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে কানাডার ছয়জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।
কানাডার এই বিবৃতি আন্দোলনকর্মী ও পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সেই অভিযোগকে উসকে দিয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ভারত সরকার বিদেশের মাটিতে, বিশেষ করে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে দমন–পীড়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে এবং ভারত রাষ্ট্রের সমালোচকদের তারা লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে।
কানাডার এই অভিযোগকে ‘হাস্যকর’ বলে খারিজ করে দিয়েছে ভারত। উল্টো অভিযোগ করেছে, এটা কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ভোটে জেতার রাজনৈতিক এজেন্ডা।
কূটনৈতিক তিক্ততা শুরু কীভাবে
গত বছরে ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় একটি শিখ মন্দিরের বাইরে শিখ আন্দোলনকর্মী হারদীপ সিং নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের আগপর্যন্ত ভারতের সঙ্গে কানাডা তুলনামূলকভাবে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিল।
নিজ্জর ভারতের পাঞ্জাব রাজ্য ভেঙে খালিস্তান নামে একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিলেন। খালিস্তানিদের আন্দোলন ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এই আন্দোলনের অধিকাংশ নেতা বিদেশে বাস করা পাঞ্জাবি।
২০২০ সালের একটি সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কানাডার কাছে নিজ্জরকে হস্তান্তর করার দাবি জানিয়েছিল।
গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো নজিরবিহীনভাবে প্রকাশ্যে বিবৃতি দেন যে নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারতীয় এজেন্টরা জড়িত থাকার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ আছে। ভারত দৃঢ়ভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এ অভিযোগকে অবাস্তব বলে অভিহিত করে পাল্টা অভিযোগ করে যে কানাডা সন্ত্রাসীদের ও ভারতবিরোধী লোক যারা ভারত রাষ্ট্রের জন্য হুমকি, তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছে।
এরপর ভারত কানাডার জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে এবং দিল্লি দূতাবাস থেকে ৪১ জনকে বের করে দেয়। কানাডিয়ানদের জন্য সব ধরনের ভিসা আবেদনও স্থগিত করে।
এ বছরের শুরুর দিকে কানাডিয়ান পুলিশ নিজ্জর হত্যার সঙ্গে জড়িত স্কোয়াডে যুক্ত থাকার অভিযোগে তিনজন ভারতীয় নাগরিককে গ্রেপ্তার করে। কানাডার পুলিশ বলেছিল, ‘ভারত সরকারের সঙ্গে ওই তিনজনের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত করেছে তারা।’ ভারত সরকার এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলেছিল, ভারতকে দোষ দেওয়ার ক্ষেত্রে কানাডার একটা ‘রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা’ আছে।
কানাডার পুলিশ নতুন কী অভিযোগ আনল
সম্প্রতি কানাডিয়ান পুলিশ একটি বিস্ফোরক প্রেস কনফারেন্সে দাবি করে করে যে তারা তথ্য–প্রমাণ উদ্ঘাটন করেছে যে ভারতের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও দূতাবাসের কর্মকর্তারা হত্যা, নিগ্রহ ও কানাডিয়ান শিখদের হুমকি দেওয়ার সঙ্গে জড়িত ‘অপরাধীদের নেটওয়ার্কের’ সঙ্গে যুক্ত।
কানাডিয়ান পুলিশ অভিযোগ করেছে, ভারতীয় কূটনীতিকেরা ও কানাডা দূতাবাসের কর্মকর্তারা তথ্যের জন্য লোকজনকে ভয়ভীতি দেখানো ও জবরদস্তি করেছে। খালিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত আছেন এমন ব্যক্তিদের সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করেছে।
তারা আরও বলেছে, তারা এটা বিশ্বাস করে যে ভারতীয় এজেন্টরা ভারতীয় কুখ্যাত মাফিয়া বস লরেন্স বিষ্ণোইয়ের গ্যাংয়ের সদস্যদের সঙ্গে মিলে টার্গেট করা ব্যক্তিদের ওপর হামলা ও হত্যার মতো অপরাধ করেছে।
কানাডার কর্মকর্তারা আরও বলেন, তাঁদের কাছে এই তথ্য–প্রমাণ আছে যে কানাডায় নিযুক্ত ভারতের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক সঞ্জয় কুমার ভার্মা ও দূতাবাসের কর্মীরা নিজ্জর হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
এরপর সংবাদ সম্মেলনে ট্রুডো অভিযোগের তিরকে দ্বিগুণ করেন। তিনি বলেন, কানাডার কাছে স্পষ্ট ও বিশ্বাসযোগ্য তথ্য–প্রমাণ আছে যে ভারত সরকারের এজেন্টদের কর্মকাণ্ড তাঁর দেশে জননিরাপত্তার ক্ষেত্রে বড় হুমকি তৈরি করেছে। ভারত সেটা অব্যাহতভাবে করে চলেছে।
ট্রুডো বলেন, গত সপ্তাহে তিনি এ ব্যাপারে মোদির সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। সিঙ্গাপুরে দুই দেশের শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বৈঠকে কানাডার কর্মকর্তারা ভারতের কর্মকর্তাদের হাতে ভারতীয়দের সহিংসতা ও আক্রমণের বিস্তারিত তথ্য–প্রমাণ তুলে দেওয়া হয়েছে এবং ভারত সেটা অস্বীকার করেছে।
ট্রুডো আরও বলেন, কানাডার নাগরিকদের হামলার জন্য কূটনীতিকদের ব্যবহার করা ও সংগঠিত অপরাধের পথ বেছে নেওয়া ভারতের জন্য বিশাল এক ভুল।
ভারত কী প্রতিক্রিয়া জানাল
নিজ্জর হত্যার তদন্তে ভারতীয় কূটনীতিকেরা সন্দেহভাজন ব্যক্তি—কানাডা ভারতকে এ তথ্য জানানোর পর ভারতীয় পররাষ্ট্র দপ্তর ক্ষোভের সঙ্গে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
এক বিবৃতিতে তারা জানায়, এটা একটা হাস্যকর অভিযোগ। এ ক্ষেত্রে ট্রুডো সরকারের রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে বলে পাল্টা অভিযোগ করে তারা। ভারত বলে, কানাডা সরকার তাদেরকে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য–প্রমাণ দেয়নি।
ভারত বারবার ট্রুডোকে অভিযুক্ত করে যাচ্ছে, তিনি খালিস্তানি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। কারণ হলো তাঁর দল দেশটির শিখ সম্প্রদায়ের কাছ থেকে প্রচুর সমর্থন পায়। জন্মভূমি পাঞ্জাবের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ কানাডায় বাস করে।
ভারত ঘোষণা দেয়, নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে তারা কানাডা থেকে তাদের ছয়জন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিককে প্রত্যাহার করে নিয়েছে। যাহোক কানাডিয়ান কর্মকর্তারা সংবাদ মাধ্যমে বলেছেন যে তাঁরাই আগে ভারতীয় কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছেন।
আর কারা লক্ষ্যবস্তু হতে পারে
অন্য দেশে বাস করছেন খালিস্তানি আন্দোলনকর্মীদের মধ্যে একমাত্র নিজ্জরই ভারত সরকারের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছেন এমনটা নয়।
গত বছরের নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের তদন্তকারীরা বলেছিলেন, ভারত সরকারের একজন কর্মীর দ্বারা গুরপিত সিং পান্নুনের হত্যাচেষ্টা ভন্ডুল করে দিয়েছে। পান্নুন সামনের সারির একজন শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সামনের সারির আরও কয়েকজন খালিস্তানি শিখ নেতা জানিয়েছেন যে তাঁদের জীবননাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এ বছর গার্ডিয়ানকে বলা গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, বিদেশের মাটিতে বাস করা সন্ত্রাসীদের নির্মূল করার বৃহত্তর কৌশলের অংশ হিসেবে ভারত সরকার কয়েকজন শিখসহ পাকিস্তানের কয়েক ডজন ব্যক্তিকে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছে
এখন কী হবে
ভারত ও কানাডার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। খুব তাড়াতাড়ি সেটার উন্নয়ন হবে এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
কানাডা বলেছে তারা নিজ্জর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত এবং ভারতের অব্যাহত সহিংসতার অভিযোগগুলো ফাইভ আইসের সঙ্গে সমন্বিতভাবে তদন্ত করবে। ফাইভ আইস হলো যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের গোয়েন্দা তথ্য আদান–প্রদানের সংস্থা।
যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে ভারত সরকারের হত্যাচেষ্টার অভিযোগকে ‘সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে’। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ঘটনা তদন্তের জন্য ভারতের একটি তদন্ত দল ওয়াশিংটনে এসেছে।
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে কিন্তু কানাডার তদন্তে সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এ ঘটনাপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য ভূরাজনৈতিক প্রভাব থাকতে পারে। ভারতকে একটা ক্রমবর্ধমান পরাশক্তি হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং দেশটি পশ্চিমা দেশ যেমন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক মিত্র।
যাহোক, এই সম্পর্ক জটিল হয়ে উঠতে পারে, যদি সত্যি সত্যি এই অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া যায় যে মোদি সরকার বিদেশের মাটিতে দমন–পীড়নের সঙ্গে জড়িত।