ইউরোপে বসে এটা বিশ্বাস করা বেশ সহজ যে সারা দুনিয়াই কমলা হ্যারিসকে চাইছে—যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে। বিষয়টা ঠিক এ রকম নয়। বরং বিশ্বের অনেক শক্তিশালী সরকার বরং চায় যে ডোনাল্ড ট্রাম্প যেন আসন্ন নির্বাচনে জয়লাভ করেন।
ডোনাল্ডপন্থী শিবিরে আছে আর্জেন্টিনা, ইসরায়েল, রাশিয়া, ভারত, হাঙ্গেরি ও সৌদি আরব। হ্যারিসপন্থী শিবিরে দেখা মিলবে ইউক্রেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বেশির ভাগ দেশ, ব্রিটেন, জাপান, কানাডা, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরও অনেক দেশের।
ট্রাম্পের দল জয়ী হোক, রাশিয়া তা মনেপ্রাণে চায়। ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইউক্রেনের সাহায্য কমিয়ে দেবে, যা প্রকারান্তরে ভ্লাদিমির পুতিনকে সেই বিজয়টাই এনে দেবে, যা তিনি এত দিন পর্যন্ত রণক্ষেত্রে পাননি। কমলা হ্যারিস জয়ী হোক, এমনটাই তিনি চান বলে সহাস্যে পুতিন যে মন্তব্য করেছেন, তা থেকে আসলে এটা বোঝা যায় যে তিনি বিদ্রূপে কতটা দক্ষ।
পুতিনের যা স্বপ্ন, তা ইইউর জন্য দুঃস্বপ্ন। যদি ইউক্রেন পরাজিত হয়, তাহলে ইইউ ও ন্যাটোর পূর্ব দিক সম্ভাব্য রুশ আগ্রাসনের ঝুঁকির মধ্যে পতিত হবে। ট্রাম্প যদি [নির্বাচিত হয়ে] যুক্তরাষ্ট্রকে ন্যাটো থেকে সত্যি বের করে নিয়ে (তাঁর অনেক সাবেক সহযোগী এমনটা আভাস দিয়েছেন) না–ও আসেন, তবু তিনি এই জোটকে দুর্বল করে ফেলবেন। তিনি যেটা বহুবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে ন্যাটো জোটের মিত্রদের সুরক্ষা দেবে না, সেটা করবেন।
ট্রাম্প যেসব আমদানি পণ্যের ওপর ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করতে চান, তা ইউরোপের অর্থনীতির জন্য একটা বড় হুমকি, বিশেষত জার্মানির মতো বড় রপ্তানিকারক দেশগুলোর জন্য। এর ফলে ইইউর সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
ইউরোপে অবশ্য এমন কিছু সরকার আছে, যারা হ্যারিসপন্থী থাকার বিষয়ে ঐকমত্যে ফাটল ধরাবে। ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির রাজনৈতিক শিকড় নিহিত আছে চরম দক্ষিণপন্থায় এবং তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে ইইউর সমঝোতায় নিজেকে একজন ভালো মধ্যস্থতাকারী বলে মনে করেন।
হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবানতো আমেরিকা মেগা (মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) ডানপন্থীদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। তারা হাঙ্গেরীয় প্রধানমন্ত্রীর মতোই অভিবাসীবিদ্বেষী এবং তাঁর কাছ থেকে এটা শিখতে বিশেষভাবে আগ্রহী যে কীভাবে তিনি হাঙ্গেরির গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বারোটা বাজাতে সফল হয়েছেন।
ট্রাম্পের বিজয়কে ওরবান দেখবেন এভাবে যে পশ্চিমা দুনিয়া থেকে তাঁর অনুকূলেই মতাদর্শিক হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। ফ্রান্সের ন্যাশনাল র্যালি ও জার্মানির অলটারনেটিভ ফর জার্মানির মতো জনতুষ্টিবাদী ও চরম দক্ষিণপন্থী ইউরোপীয় রাজনৈতিক দলগুলো হয়তো ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের কাছ থেকে তাদের জন্য নির্দেশনা ও সমর্থন প্রত্যাশার করবে। ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের শাসনক্ষমতায় ফিরে আসার মানে হলো ইউরোপের উদার গণতন্ত্রের বড় ধরনের বিপদের মধ্যে পড়া। কারণ, এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পাশাপাশি নিজেদের চরম দক্ষিণপন্থীরা থাকায় তিন দিক থেকে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে হবে।
ক্ষমতার রাজনীতির প্রতি ট্রাম্পের গুরুত্বারোপের পাশাপাশি গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রতি তাঁর নির্লিপ্ততা ইইউকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। কিন্তু তাঁর এই অবস্থানই আবার তাঁকে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ইসরায়েল, মোহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি আরব এবং নরেন্দ্র মোদির ভারতের পছন্দের অংশীদার করে তুলেছে।
ইসরায়েলে কমলা হ্যারিসকে সন্দেহের চোখে দেখা হয়। কেননা তিনি জো বাইডেনের চেয়ে ইসরায়েলের বড় সমালোচক যদিও মাত্রাটা সামান্য। নিজের পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচির দোহাই দিয়ে তিনি সম্প্রতি কংগ্রেসে নেতানিয়াহুর বক্তৃতার সময় অনুপস্থিত ছিলেন। একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তা আমাকে বলেছেন, ‘শতকরা ৮০ জন আমেরিকান ইহুদি কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবে। কিন্তু ৮০ শতাংশ ইসরায়েলি ট্রাম্পকেই ভোট দিত।’
যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে (এমবিএস) একজন ‘অন্ত্যজ’ বানানোর আলোচনা থেকে বাইডেন প্রশাসন অনেক আগেই সরে এসেছে। বরং মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার প্রভাব বাড়ানোর জন্য সৌদি-যুক্তরাষ্ট্র নতুন নিরাপত্তা চুক্তির বিষয়ে কাজ করছে। কিন্তু এমবিএস এটা মনে রাখবেন যে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগি নিষ্ঠুরভাবে খুন হওয়ার পর কীভাবে ডেমোক্র্যাটরা তাঁকে পরিত্যাগ করার প্রচেষ্টায় নেতৃত্ব দিয়েছিল।
সৌদি নেতার কাছে এ রকম আভাসও থাকতে পারে যে জো বাইডেনের উপদেষ্টাদের তুলনায় কমলা হ্যারিসের দল তাঁর দেশকে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার বিষয়ে তুলনামূলকভাবে অধিক সন্দেহপ্রবণ। বিপরীতে এমবিএস ও তাঁর কোটারিগোষ্ঠী ট্রাম্প শিবিরের সঙ্গে দীর্ঘ সময় ধরে ঘনিষ্ঠ কূটনীতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক উপভোগ করে চলেছে, বিশেষত সাবেক প্রেসিডেন্টের জামাতা জার্ড কুশনারের সঙ্গে।
ভারতের সঙ্গে জোরালো সম্পর্কের বিষয়ে ওয়াশিংটনে দুই পক্ষই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে মোদি সরকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিও স্বাক্ষর করেছে। তবে নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর অনুসারীরা মনে করেন যে সংখ্যালঘু অধিকার ও গণতান্ত্রিক সুরক্ষা নিয়ে ডেমোক্র্যাটরা তাঁদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে বেশি তৎপর।
বাংলাদেশে সম্প্রতি ‘শাসনক্ষমতার পালাবদল’ ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীদের হস্তক্ষেপ থাকার অভিযোগ তোলা এখন ভারতে নিত্যকার বিষয় হয়ে গেছে। ভারতীয়দের আশঙ্কা যে এর ফলে [বাংলাদেশে] ইসলামপন্থীরা শাসনক্ষমতা গ্রহণ করবে। একজন লৌহমানব নেতা ও গোষ্ঠীভিত্তিক জাতীয়তাবাদী হিসেবে মোদি তো হ্যারিসের তুলনায় ট্রাম্পের সঙ্গেই অধিকতর স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, যদিও প্রথমজনের ভারতের সঙ্গে পারিবারিক যোগসূত্র রয়েছে।
তবে পূর্ব এশিয়ায় আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সবারই ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার সম্ভাবনায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। চীনা শক্তির আধিপত্য বিস্তারকে ঠেকিয়ে রাখতে বাইডেনের দল বেশ ভালোভাবেই ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পেরেছে।
কিন্তু ট্রাম্প এটা পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে তিনি জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের অবাধ সুবিধা গ্রহণকারী হিসেবে দেখে থাকেন। আবার বিভিন্ন সময়ে তিনি এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন যে তাইওয়ানকে রক্ষা করার বিষয়ে তাঁর আগ্রহ খুবই কম।
এ বিষয়গুলো চৈনিক নেতাদের কানে সংগীতের সুর হিসেবেই বাজবে যাঁরা তাইওয়ানকে ত্যাজ্য অবস্থায় এবং এশিয়ায় আমেরিকার মৈত্রী ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে দেখতেই পছন্দ করবেন। আবার ট্রাম্প চীন থেকে আমদানির ওপর সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ হারে শুল্কারোপের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন যেখানে আমেরিকা হলো চীনের সবচেয়ে বড় রপ্তানির বাজার।
এ ছাড়া ট্রাম্পকে ঘিরে রয়েছেন তাঁর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর মতো ভীষণ চীনবিদ্বেষী লোকজন। তাঁরা যদি ক্ষমতা হাতে পান, তাহলে চীন বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি প্রচণ্ড সংঘাতমূলক হয়ে উঠবে।
অনেক ভিনদেশি সরকারের জন্য ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য শুধু মতাদর্শিকই নয়, বরং মেজাজগত। হ্যারিস প্রশাসন স্থিতিশীল যেমন হবে, তেমনি হবে অনুমানযোগ্য। ট্রাম্প তো ওভাল অফিসে বন্যতা ও অস্থিরতা ফিরিয়ে আনবেন।